দেশজুড়ে জমি বিক্রয় ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন এনেছে সরকার। এখন থেকে অংশীদারভিত্তিক বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত কোনো জমি আপোষ মীমাংসা ছাড়া বিক্রি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে যতদিন পর্যন্ত জমির অংশীদাররা নিজেদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বন্টননামা দলিল সম্পন্ন না করবে, ততদিন পর্যন্ত কেউ এককভাবে সেই জমি বিক্রি করতে পারবে না।
সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও মৌজায় এই আইন কার্যকর করা হয়েছে। অর্থাৎ এখন থেকে কোনো ভূমি মালিক তার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমি বিক্রি করতে চাইলে, প্রথমে তাকে অংশীদারদের সঙ্গে আপোষ মীমাংসার ভিত্তিতে একটি বন্টননামা দলিল বা বাটোয়ারা চুক্তি করতে হবে। অন্যথায় বিক্রয়, রেজিস্ট্রেশন এবং নামজারি সব প্রক্রিয়াই নিষিদ্ধ।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ভূমি মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এই বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে। প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, কেউ যদি বেআইনিভাবে জমি বিক্রির চেষ্টা করে, বা ঘুষের মাধ্যমে সাব-রেজিস্ট্রারের কাছ থেকে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নেয়, তাহলেও সেই জমির নামজারি হবে না। এমনকি যদি কোনো এসিল্যান্ড অন্যায়ভাবে নামজারি করে ফেলেন, পরবর্তীতে আদালতের মাধ্যমে সেই নামজারি বাতিল হয়ে যাবে।
এই আইনের পেছনে রয়েছে ২০২৩ সালে পাশ হওয়া ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন। পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে এই আইন কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও ভূমিদস্যু ও স্বার্থান্বেষী মহলের বাধার কারণে সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরই আইনটি কার্যকর করার ঘোষণা দেয় এবং ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে প্রজ্ঞাপন জারি করে সারাদেশে তা প্রয়োগ শুরু করে।
আইন অনুযায়ী, কোনো উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বা ক্রয়কৃত সম্পত্তি যদি একাধিক অংশীদারের মধ্যে বিভক্ত থাকে, তাহলে অংশীদারদের লিখিত সম্মতি ছাড়া জমির কোনো অংশ বিক্রয় করলে সেটি অবৈধ ঘোষণা করা হবে। ক্রেতা সেই জমির বৈধ মালিকানা স্থায়ীভাবে অর্জন করতে পারবে না।
তবে এই নিষেধাজ্ঞা থেকে বৈধ উপায়ে মুক্তির পথও রাখা হয়েছে। যদি কোনো মালিক এককভাবে জমি বিক্রি করতে চান, তাহলে তাকে অংশীদারদের সঙ্গে আপোষ মীমাংসায় এসে বন্টননামা দলিল করতে হবে। আর যদি আপোষে সম্ভব না হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আদালতে একটি বাটোয়ারা মামলা (Partition Suit) দায়ের করতে পারবেন।
এই মামলার জন্য মাত্র তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নথি প্রয়োজন হবে—
1️⃣ ওয়ারিশান সনদ, যা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা পৌর মেয়রের কাছ থেকে নিতে হবে।
2️⃣ রেকর্ড খতিয়ান বা দলিল, যা প্রমাণ করবে সম্পত্তির মালিকানা।
3️⃣ খাজনা প্রদানের দাখিলা ও জাতীয় পরিচয়পত্র (NID)।
এই তিনটি কাগজপত্রসহ একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর মাধ্যমে বাটোয়ারা মামলা করলে আদালত দ্রুত নিষ্পত্তি করবে। আদালত প্রয়োজনবোধে একজন সরকারি আমিন বা সার্ভেয়ার পাঠিয়ে জমির বাস্তব অবস্থার ভিত্তিতে সুষম বন্টন নিশ্চিত করবে। এরপর আদালতের রায়ে প্রতিটি অংশীদারের নামে আলাদা মালিকানা নির্ধারিত হবে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নামজারি সম্পন্ন করতে পারবেন।
একবার আদালতের মাধ্যমে বণ্টন নির্ধারিত হলে, অন্য কোনো ওয়ারিশ বা অংশীদার পরবর্তীতে তাতে আপত্তি জানাতে পারবে না। আদালতের প্রদত্ত ডিক্রি বা রায় চূড়ান্ত ও কার্যকর হিসেবে গণ্য হবে।
ফলে, যেসব জমি বণ্টননামা ছাড়া বিক্রি করা হচ্ছে, সেগুলোর রেজিস্ট্রেশন বা নামজারি কোনোভাবেই বৈধ হবে না। এমনকি ক্রেতা চাইলেও সেই জমির মালিকানা স্থায়ীভাবে ধরে রাখতে পারবে না। তবে যিনি আইন অনুযায়ী বণ্টননামা দলিল বা আদালতের মাধ্যমে বাটোয়ারা মামলা সম্পন্ন করবেন, তিনি নিশ্চিন্তে জমি বিক্রি করতে পারবেন।
এই উদ্যোগের ফলে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পারিবারিক জমি বিরোধ, প্রতারণা ও ভূমিদস্যুতা রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।